পথভোলা মুসাফির
লিখেছেন লিখেছেন একপশলা বৃষ্টি ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৮:১৮:০১ রাত
2য় কিস্তি...
বক্তব্য শেষে আব্দুর রাহমান এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বদরও মর্মাহত। আব্দুর রাহমানের পরিবার তার মালিক-পরিবার। মালিকের প্রাণ রক্ষা করা নিজের কর্তব্য। মনিবের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে জবাব দিল,
“আমীর! আমি যা কিছু করেছি সেটা আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। যেই মুহূর্তে জানতে পারলাম, কালো পতাকাধারী বনু আব্বাসের লোকেরা আমাদের ধাওয়া করে এই বসতিতে এসে উপস্থিত হয়েছে, সাথে সাথে তাবুর উদ্দেশে দৌঁড়তে শুরু করলাম। আপনার ভাই মারা যাওয়ায় আমি নিজেও ব্যথিত, মর্মাহত। কিন্তু এভাবে বসে থেকে কোনো লাভ হবে না। যত দ্রুত সম্ভব নতুন ঠিকানার সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হবে। এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থা পথভোলা মুসাফিরের মতো। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এমন কোনো আশ্রয়স্থল, পথনির্দেশ কিংবা লক্ষস্থল নেই, যার আশায় পথ চলতে পারি। অন্যদিকে পরিস্থিতির মোকাবেলা না করে অসহায় আত্মসমর্পনও করতে পারি না...”
আব্দুর রাহমানের বাধায় বদর বক্তব্য শেষ করতে পারল না। তাকে থামিয়ে বললেন,
“বদর! আমি অনেকবার বলেছি, তুমি এখন থেকে আমাকে আমীর বলে ডাকবে না। আমি বর্তমান পরিস্থিতিতে তোমাকে নিজের ভাইয়ের মতোই মনে করি, ভালোবাসি। আমাকে ভাই বলে ডাকলেই বেশি খুশি হবো।”
স্বভাবত:ই বদর খুশি হল। ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা দেখা দিল। মুখে হাসি ধরে রেখে আব্দুর রাহমানের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,
“আমীর! এভাবে সম্ভোধন করতে পারা বদরের জীবনের পরম আরাধ্য। আপনি আমাকে এই সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না। এছাড়া আপনি তো জানেন, পুরাতন অভ্যাস রক্তমাংসে মিশে থাকে, সহজে পরিবর্তন করা যায় না। একবার যে অভ্যাস হয়ে যায়, মৃত্যু পর্যন্ত সেটাই রয়ে যায়। দীর্ঘদিন আপনার কেনা গোলাম হিসেবে কাটিয়েছি। আপনাকে আমীর বলে ডেকে এসেছি। দিনে দিনে যে ব্যাপারটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছেÑসেটা কি সহজে যেতে চায়, বলুন? এসব কারণ ছাড়াও আমার জীবন, আমার সত্ত্বা আপনার অনুগ্রহের কাছে এতটাই ঋণী যে, যদি আমীর বলে সম্ভোধন না করি তবে তৃপ্তি পাই না। আপনি এমন এক ব্যক্তিÑযিনি জালেমের নির্যাতন থেকে এই অধমকে মুক্তি দিয়েছেন। ঝড়-ঝাপটায় রক্ষা করেছেন। অনাথ-অসহায়ের মতো হতদরিদ্র জীবনের অভিশাপ থেকে বের করে এনেছেন। এরপর পূর্ণচন্দ্রের জোঁছনা-কোমল আলো-ঝলমলে আঙিনায় ছেড়ে দিয়েছেন। বিবর্ণ জীবনের কবল থেকে টেনে এনে বর্ণিল জীবনের মুখ দেখিয়েছেন। আপনি আমাকে গোলামীর পিঞ্জর থেকে বের করে আযাদির উন্মুক্ত আকাশে ছেড়ে দিয়েছেন। এর বিনিময়ে...”
আব্দুর রাহমান খিলখিল করে হেসে উঠলেন। হাতের ইশারায় বদরকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
“বদর! আমি তোমার জন্য কিছুই করিনি। এ পর্যন্ত তুমি যা পেয়েছ সবই নিজস্ব অর্জন। তুমি গোলামীর জিঞ্জির ছিঁড়ে আযাদির মঞ্জিলে পা রেখেছ, সেটা তোমার পরিশ্রমের ফসল এবং নিষ্ঠার প্রতিদান হিসেবেই পেয়েছ। আমার বর্তমান অবস্থাও নিজ চোখে দেখতে পাচ্ছ। আমি চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি আর গন্তব্যহীন পথভোলা মুসাফিরের মতো একটু মাথা গুঁজার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছি। এ অবস্থায় তোমার উপস্থিতি আমার জন্য সজীব স্বপ্নের আলোক স্ফুরণ এবং পিপাসী হৃদয়ে সুমিষ্ট বর্ষণ ছাড়া কিছুই নয়।
বদর! এই সমাজটা নিরেট বিবেকশুন্য। লোকগুলোর মনমস্তিষ্ক কলুষিত। এদের ভীড়ে আমি নিরাশ্রয়, দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। বন্ধু বা সহমর্মী হয়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউই ছিল না। এ অবস্থায় তুমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এসেছ। নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছ। এ যুগে এমন সহযোগিতা পাওয়ার কল্পনাও করা যায় না; এমনকি নিজের আপনজন হলেও নয়।
সর্বশেষ যাত্রায় ফোরাত নদী পাড়ি দিতে এসে তুমি যা করেছÑসেটা ভোলার মতো নয়। কেবল আমার জীবনই নয়; আমার ভাই এবং এই অবুঝ শিশুটির জীবনও বারবার রক্ষা করেছ। যার ভিত্তিতে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমার জীবনের নিরাপত্তা, মনের শান্ত¦না, প্রভাতের ¯স্নিগ্ধতা, গোধূলীর প্রাণবন্ত বিচরণ এবং ঠিকানার সন্ধান কেবল তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে। তোমাকে ছাড়া নিজেকে অপূর্ণ আর র্দুবল বলেই মনে করছি।
জানো বদর! মাঝেমধ্যে মনে হয়, তুমি সাথে না থাকলে অনেক আগেই কোনো না কোনো স্থানে লাশ হয়ে পড়ে থাকতাম! এতদিন বেঁচে থাকা সম্ভবই ছিল না। আজ স্বীকার করছি, তোমাকে ছাড়া ভবিষ্যতেও কোনো কিছু অর্জন করতে পারব বলে মনে হচ্ছে না।”
বদর জিহ্বা দ্বারা শুকনো ঠোঁটগুলো ভিজিয়ে নিল। নতমস্তকে জবাব দিল,
“আমীর! এই অধম আপনার জন্য কিছুই করতে পারি নি। আর যদি কিছু করেই থাকি, তবে ঐ কাজের দোহাই দিয়ে বলছি, কৃতজ্ঞতা আদায়ের অধিকারটুকু আমার থেকে ছিনিয়ে নেবেন না।”
আব্দুর রাহমান হাসলেন। সামনে অগ্রসর হয়ে বদরকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কপালে বেশ কয়েকবার চুমু খেলেন। অতঃপর কাঁধের উপর হাত চাপড়ে দিয়ে বললেন,
“ঠিক আছে, বদর! তুমি যা ভালো মনে করো, তাই হবে। আর বারণ করব না।”
বদর হাসল। এরপর কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলল,
“আমীর! সামনে নল-খাগড়ার ঝাড় দেখা যাচ্ছে। আসুন ওদিকে যাই। আমি চামড়ার ব্যাগে করে কিছু কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছি। সবার জন্যই অতিরিক্ত কিছু কাপড় আছে এখানে। ওদিকে গিয়ে প্রথমে নিজেদের ভেজা কাপড়গুলো পরিবর্তন করে রোদে ছড়িয়ে দেই। একদিকে কাপড়গুলো শুকাতে থাকবে, অন্যদিকে কী করব? কোথায় যাব?Ñএসব নিয়ে চিন্তা করে দেখব। ধাওয়াকারীরা চলে গেছে, ওদের নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। এখন ভাবনার বিষয় কেবল একটিইÑকোনদিকে যাত্রা করব? কার কাছে গেলে আমাদের লক্ষ অর্জন সহজ হবে?”
বদরের কথা শুনে আব্দুর রাহমান বিন মুআবিয়াও সম্মতি জানালেন। সন্তানকে কোলে নিতে হাত বাড়ালেন। তার আগেই বদর ছুটে এসে ছেলেটিকে কোলে তুলে নিল। বিনীত কণ্ঠে বলল,
“আপনি চলুন, আমি ওকে নিয়ে আসছি।”
আব্দুর রাহমান নিজের হাত গুটিয়ে নিলেন। তারপর মুচকি হেসে চুপচাপ সামনের দিকে পা বাড়ালেন।
নদীর কাছেই নল-খাগড়ার ঝাড়। এদিকটায় জনমানবের আনাগোনা তেমন একটা চোখে পড়ছে না। বেশ নিরিবিলি এলাকা। তারা ঝাড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। জবজবে ভিজা কাপড়, পানি ঝরছে গা থেকে। বদর চামড়ার ব্যাগ খুলে শুকনো কাপড় বের করল। দুজনে জামা-কাপড় পাল্টালেন। শিশু সুলাইমানের কাপড়ও পরিবর্তন করে দেওয়া হল। বদর ভেজা কাপড়গুলো রোদে ছড়িয়ে দিল। সবাই বসে পড়লেন। বেশকিছুক্ষণ চুপচাপ, কারও মুখে কোনো কথা নেই। দীর্ঘসময় পর বদর নীরবতা ভাঙলো। আমীর আব্দুর রাহমানকে সম্ভোধন করে বলল,
“আমীর! আমার মনে হয়, এভাবে বসে থেকে লাভ নেই। আসুন, সর্বপ্রথম খাবারের ব্যাপারে চিন্তা করি। দীর্ঘ সময় যাবত খাবার মুখে নেওয়া হয়নি। ফোরাতের ওপারেও খাবার সংগ্রহ করতে চাচ্ছিলাম। সে উদ্দেশ্যেই গ্রামের দিকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ঐ সৈন্যরা চলে আসায় খালি হাতেই ফিরে আসতে হয়। এরপর ক্ষুধার্ত শরীরের উপর ক্লান্তির ছাপÑশরীরটা নাকাল করে ছেড়েছে। প্রচ- মানসিক চাপে এতক্ষণ সেটা উপলব্ধি করা যায় নি। আপনিও নিশ্চয়ই খিদেটা অনুভব করতে পারছেন। সত্য বললে, আমারও বেশ খিদে পেয়েছে।”
আব্দুর রাহমান মুচকি হাসলেন। কষ্টের মাঝে ক্লিষ্টের হাসি। বদরের পিঠে আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে জবাব দিলেন,
“বদর! আমার জন্য এতটা চিন্তা করতে হবে না। আমি এখন দুঃখ-দুর্দশা আর বিপদাপদে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে নিজের আপন করে নিয়েছি। মনে মনে ভাবি, আগামী দিনগুলিতে হয়ত; এই আপনজনদের নিয়েই জীবনযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।”
কথাগুলো শেষ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। যেন, বুকের কষ্টগুলো ঠেলে বের করে দিচ্ছেন আর শুন্য বুকটা অনুভব করার চেষ্টা করছেন। বেশকিছুক্ষণ নীরব। কারও মুখে কথা নেই। অতঃপর বদরকে সম্ভোধন করতে শোনা গেল,
“বদর! আমার ভাই! আবারও প্রথম থেকে শুরু করতে হবে, সবকিছু নতুন করে সাজাতে হবেÑএজন্য একটা আশ্রয় চাই, একটা নিরাপদ ঠিকানা চাই। বদর! এবার বলো, এই মুহূর্তে আমরা কী করতে পারি? কার উদ্দেশ্যে, কোন দিকে রওয়ানা হতে পারি? কে আমাদের আশ্রয় দেবে? নিরাপদ ঠিকানার চাহিদা মেটাবে? বলো ভাই, পরামর্শ দাও?
আমরা এখন পথভোলা মুসাফির। এমন কোনো আশ্রয়স্থল নেই, যেখানে মাথা গুঁজার ঠাঁই নিতে পারি। এমন কোনো বন্ধুও নেই, যার কাছে নিরাপদ ঠিকানার সন্ধান পেতে পারি।”
“আমার কাছে একটি রাস্তা আছে।” গম্ভীর মুখে কথা বলল বদর।
আব্দুর রাহমান নড়েচড়ে বসলেন। বুকটা কেঁপে উঠল। অকূল সমুদ্রে খড়কুটোর সন্ধান লাভের আশায় বদরের দিকে তাকালেন। বদরের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। বেশকিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। এবার আস্তে আস্তে কথা বলল,
“চলুন, কোনো লোকালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হই। কিংবা সরাইখানার খুঁজে বের হই। ওখানে নিজেদের ভিনদেশি মুসাফির হিসেবে পরিচয় দেব। প্রকৃত পরিচয় দেব না। আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা-পয়সা আছে। এমন অবস্থায় ফোরাত নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে, নিজেদের ঘোড়া নিয়ে আসার কথা চিন্তাও করতে পারি নি। যদি সে চেষ্টা করতাম, তবে প্রাণের আশা ছেড়ে দিতে হত। এবার আমরা কোনো সরাইখানা থেকে ঘোড়া কেনার চেষ্টা করি। এরপর ফিলিস্তিনের দিকে যাত্রা করতে পারি। মূল সড়ক ছেড়ে বিকল্প পথ ধরে ফিলিস্তিন থেকে মিশরে প্রবেশ করব। আমি জানি মিশরে আমাদের কোনো সহায়তা পাওয়ার আশা নেই। সেখানে আমরা অবস্থান করব না। বিশ্রামও নেব না। বরং পশ্চিম দিকে যাত্রা করব। আমাদের লক্ষ্য হবে বারবারোজদের নাযরা নামক গোত্র। আপনি জানেন, আপনার মায়ের বংশধারা এই গোত্রের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। আশা করা যায়, আপনার মায়ের পরিচয়ে বারবারোজদের এই গোত্রটি আমাদের আশ্রয় দেবে এবং সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যদি এমনটাই হয়, তবে আমরা কোথাও না কোথাও নিজেদের জন্য একটু স্বাধীন ভূমির ব্যবস্থা করে নিতে পারব।”
বদর একটু থামল। এরপর আমীরের শান্ত¦নার জন্য আবারও বলতে লাগল,
“আমীর! এটা নিঃসন্দেহে সত্য, এই মুহূর্তে আমরা কষ্ট আর লাঞ্চনার শিকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কিন্তু আমি আপনার কাছে একটি কথা স্পষ্ট করতে চাই, যেখানে প্রদীপের আলো দীপ্তি হারায়, উজ্জলতার মৃত্যু ঘটে, সেখানেই অনুগ্রহ ও ভালোবাসার রশ্মি আর সুবাসিত সঙ্গীতের প্রত্যাবর্তন বিজলীর ন্যায় পতিত হয়। যেখানে পাপে নিমজ্জিত কদর্যতার উল্লাস পরিলক্ষিত হয়, সেখানে কল্যাণ ও পূণ্যতার স্বর্ণালি চাঁদও দেখা দেয়। যদিও বর্তমান সময়ে আমরা বেশ দুর্দিন পার করছি, কিন্তু অবস্থা পরিবর্তন হতে বেশি সময় লাগবে না। আজ না হোক কাল সুদিন আমাদের হাতে এসে ধরা দেবেই। যেদিন এমনটা হবে, আমার আশা, আমরা নিজেদের অতীতের হতাশা ভুলে উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখব, ইনশাল্লাহ।”
চলবে.
বিষয়: বিবিধ
১১২৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন